প্রাণী-শোষণ সম্পর্কে মন্ট্রিয়েল ঘোষণা

আমরা নৈতিক এবং রাজনৈতিক দর্শনের গবেষক। আমাদের গবেষণা মূলত বিভিন্ন দার্শনিক ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। ফলে আমরা পরস্পরের অভিমতের সঙ্গে খুব কমই সহমত পোষণ করতে দেখি। কিন্তু আমরা সকলেই এ বিষয়ে একমত পোষণ করি যে, অন্যান্য প্রাণীর সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন। আমরা প্রাণীর সঙ্গে সেইসব আচরণের নিন্দা করি যেখানে প্রাণীকে গবেষণার বস্তু বা পণ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

প্রাণীকে গবেষণার বস্তু বা পণ্য হিসেবে ব্যবহার করে আমরা তাদের সঙ্গে অপ্রয়োজনীয় সহিংস আচরণ করি এবং তাদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলি। আর তাই আমরা ঘোষণা করছি যে, প্রাণী-শোষণ অন্যায্য এবং নৈতিকভাবে সমর্থন করা যায় না।

প্রাণীর আচরণ সংক্রান্ত বিজ্ঞানে এবং স্নায়ুবিজ্ঞানে এ বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত যে, স্তন্যপায়ী প্রাণী, পাখি, মাছ এবং অনেক অমেরুদণ্ডী প্রাণী সংবেদনশীল, অর্থাৎ, তারা সুখ-দুঃখ-আনন্দ-বেদনা অনুভব করতে সক্ষম এবং তাদের আবেগও আছে। এসব প্রাণী সচেতন এবং তাদের পারিপার্শ্বিক জগৎ সম্পর্কে তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। এ থেকে বোঝা যায় যে, তাদের নিজস্ব স্বার্থ আছে : আমাদের আচরণ তাদের কল্যাণময় জীবনকে প্রভাবিত করে। ফলে আমাদের আচরণ তাদের উপকার বা ক্ষতি করতে পারে। আমরা যখন একটি কুকুর বা শূকরকে আঘাত করি, আমরা যখন একটি মুরগির ছানা বা একটি স্যামন মাছকে বদ্ধ ঘরে আটকিয়ে রাখি, আমরা যখন বাছুরকে বা নেউল জাতের আধা জলচর ক্ষুদ্র প্রাণীকে মাংসের জন্য হত্যা করি বা নেউল জাতের আধা জলচর ক্ষুদ্র প্রাণীকে চামড়ার জন্য হত্যা করি, তখন আমরা অত্যন্ত গুরুতরভাবে তাদের সবচেয়ে মৌলিক স্বার্থগুলো বাধাগ্রস্ত করে তুলি।

অথচ এসব ক্ষতিকর কাজ পরিহার করা সম্ভব। চামড়ার তৈরি পোষাক পরিধান করা থেকে বিরত থাকা, মানুষের সঙ্গে উত্তেজিত ষাড়ের লড়াই বা ঘোড়া, গরু ইত্যাদি প্রাণীকে নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রতিযোগিতার প্রদর্শনীতে যাওয়া বা শিশুদের চিড়িয়াখানার বন্দি সিংহ দেখতে নিয়ে যাওয়া ইত্যাদি বিষয়গুলো পরিহার করা আমাদের পক্ষে অবশ্যই সম্ভব। ইতোমধ্যে আমাদের অনেকেই প্রাণিজ-খাদ্য না খেয়ে এখনো সুস্থ, সবল ও স্বাস্থ্যবান আছেন। এ ধরনের খাদ্যাভাস দ্বারা আমরা ভেগান অর্থনীতির বিকাশসহ এরূপ অনেক বিষয়কেই অধিকতর সহজ করে তুলতে পারি। রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের অধীন ও নিয়ন্ত্রণে থাকা প্রাণীদের সম্পদ বা পণ্য হিসেবে বিবেচনা না করা সহজেই সম্ভব।

প্রাণিকূল মানব প্রজাতির অন্তর্গত নয় বলে তাদের ক্ষেত্রে নৈতিকতার বিষযটি অপ্রাসঙ্গিক মনে করা হয়। তাই একথা মনে করা স্বাভাবিক যে, মানুষের স্বার্থের তুলনায় প্রাণীর স্বার্থ কম। এধরনের অন্তর্জাত প্রজাতিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণযোগ্য নয়। সব কিছু সমভাবে থাকলে শুধু একটি জৈবিক গোষ্ঠীর অন্তর্গত হওয়ার কারণে (তা সেটি প্রজাতি,ত্বক, রঙ বা লিঙ্গ দ্বারা চিত্রিত বা পরিচিত হোক না কেন) সেই গোষ্ঠীকে অসম মনে করা বা তাদের সঙ্গে অন্যায্য আচরণ করা যথার্থ নয়।

একই প্রজাতির বিভিন্ন সদস্যের মধ্যে যেমন নানা বিষয়ে পার্থক্য রয়েছে, ঠিক তেমনি মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর মধ্যেও নানা বিষয়ে পার্থক্য রয়েছে। তবে এ কথা অবশ্য স্বীকার করতে হয় যে, কিছু কিছু পরিশীলিত জ্ঞানীয় সামর্থ্যরে (cognitive ability) জন্য বিশেষ বিশেষ স্বার্থরক্ষার প্রয়োজন হয়ে পড়ে, এবং সে কারণে তা ভিন্ন ধরনের আচরণ করার ন্যায্যতা প্রদান করতে পারে। একজন ব্যক্তির সিম্ফনি রচনা করার সামর্থ্য, উচ্চতর গণিত সমাধানের সামর্থ্য, বা দূরবর্তী ভবিষ্যতের পরিকল্পনার সামর্থ্য অবশ্যই প্রশংসার যোগ্য, কিন্তু এসব যোগ্যতা প্রাণীর আনন্দ উপভোগ করার ক্ষেত্রে বা কষ্টভোগ না করার ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না। আমাদের মধ্যে অধিকতর বেশি বুদ্ধিমানদের স্বার্থ এবং অধিকতর কম বুদ্ধিমানদের স্বার্থ সমভাবে বিবেচনার দাবি রাখে। অন্যভাবে বললে বলতে হয় : বুদ্ধিবৃত্তির সামর্থ্য দ্বারা প্রাণীর স্তরবিন্যাস বা শ্রেণি বিন্যাস করা নৈতিকভাবে অপ্রাসঙ্গিক। তাই বুদ্ধিবৃত্তি দ্বারা প্রাণীর স্তর বা শ্রেণি বিন্যাস করার দৃষ্টিভঙ্গি নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য নয়।

সুতরাং, এই সিদ্ধান্তটি এড়িয়ে যাওয়া কঠিন : প্রাণীর সঙ্গে আমাদের অন্যায্য আচরণ তাদের জীবনধারা ক্ষতিগ্রস্ত করে, তাই প্রাণী শোষণ নিতান্তই অন্যায্য। সুতরাং, প্রাণী শোষণ বন্ধের লক্ষ্যে আমাদের কাজ করা প্রয়োজন, বিশেষ করে জবাইখানা বন্ধ করা, মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা ইত্যাদি লক্ষ্যে আমাদের কাজ করতে হবে, এবং উদ্ভিজ্জ-নির্ভর খাদ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। এসব কাজের ক্ষেত্রে আমাদের কোনো মতভেদ ও বিভ্রান্তি নেই। কিন্তু স্বল্প সময়ের মধ্যে এ ধরনের উদ্যোগ বাস্তবায়িত হবে না। এ ধরনের উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য বিশেষভাবে প্রয়োজন হবে অত্যন্ত সুসংগঠিতভাবে প্রজাতিবাদী অভ্যাস পরিত্যাগ করা এবং এবং অসংখ্য প্রতিষ্ঠানকে মৌলিকভাবে রূপান্তরিত করা। যা হোক, আমরা বিশ্বাস করি সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় প্রাণী-শোষণ বন্ধ হবে যা অত্যন্ত বাস্তবসম্মত এবং অ-মানব প্রাণীর জন্য একান্তই ন্যায়সঙ্গত।

স্বাক্ষরকারীদের নামের তালিকা

আপনি যদি নৈতিক বা রাজনৈতিক দর্শনের গবেষক হন, তা হলে এই ঘোষণার পক্ষে এখানে স্বাক্ষর করতে পারেন।

عربيdanskEsperantofrançaisDeutschEnglishΕλληνικάkiswahiliItalianoPortuguêsРусскийespañolTürkçe

Translated into Bangla by: Dr. Pradip Kumar Roy, Former Professor and Chairman, Department of Philosophy, University of Dhaka (Dhaka 1000, Bangladesh).